প্রতিকণাদের খোঁজে

 কণা ও প্রতিকণার অমীমাংসিত একটা তত্ত্ব নিয়ে আজকের এই আলোচনা। 

১৯৩০ সালে ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী পল ডিরাক একটি আশ্চর্য কণা তত্ত্ব প্রধান করেন। তিনি এমন একটা কণার কথা বলেন যার ভর ইলেকট্রনের সমান কিন্তু চার্জ হবে ধনাত্মক। ডিরাক সেই কণার নাম দেন পজিট্রন। সাধারণ অর্থে কণাটির নাম হচ্ছে অ্যান্টি-ইলেকট্রন বা প্রতি ইলেকট্রন। বিজ্ঞানী ডিরাকের মতে  প্রতিটি মৌলিক কণার ই প্রতিকণা রয়েছে এবং প্রতিকণার ভর হবে মূল কণার সমান কিন্তু চার্জ হবে মূল কণার বিপরীত।  অর্থাৎ মূল কণিকা ধনাত্মক হলে প্রতিকণা হবে ঋণাত্মক এবং মূল কণিকা ঋণাত্মক হলে প্রতিকণা হবে ধনাত্মক চার্জ যুক্ত। 

তখনো কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়নি। সেসময় প্রোটন ও নিউট্রনকে ও মূল কণা মনে করা হতো। তাই প্রোটনের প্রতিকণার নাম অ্যান্টি-প্রোটন ও নিউট্রনের প্রতিকণার নাম  দেওয়া হলো  অ্যান্টি-নিউট্রন। কিন্তু নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ কণা। হিসাব মতে নিউট্রনের প্রতিকণা থাকার কথা নয়। কিন্তু পরে এর সমাধান হয়। তার আগে ১৯৩২ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী অ্যান্ডারসন গবেষণাগারে পজিট্রন আবিষ্কার করেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ হয় পল ডিরাকের তত্ত্ব সঠিক ছিল। যাই হোক, একসময় কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়। তখন দেখা যায় ইলেকট্রন মূল কণিকা হলেও প্রোটন আর নিউট্রন মূল কণিকা নয়। এগুলো দুই ধরনের কোয়ার্ক দিয়ে তৈরী। আপ কোয়ার্ক আর ডাউন কোয়ার্ক। আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্ক এর প্রতিকণা দিয়ে  তৈরী হয় অ্যান্টি-প্রোটন ও অ্যান্টি-নিউট্রন। তেমনিভাবে মহাবিশ্বে যত কণা আছে তাদের সবার প্রতিকণা থাকার কথা। অন্তত কণা পদার্থ বিজ্ঞান তাই বলে। কিন্তু সেসব প্রতিকণারা কোথায় থাকে? আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি, এগুলো সবই সাধারণত মূল কণিকা দ্বারা তৈরী।  প্রতিকণার ঠাই এখানে নাই। কারণ প্রতিকণাদের চার্জ উল্টো। তাই মূল কণার সংস্পর্শে আসলেই এদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে দুটি কণাই ধ্বংস হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু শক্তি। আমাদের এই মহাবিশ্বে যদি প্রতিকণারা লুকিয়ে থাকত, তাহলে অহরহ মূল কণিকাদের সাথে সংঘর্ষ ঘটিয়ে পুরো মহাবিশ্বকেই ধ্বংস করে দিত। অথচ পদার্থ বিজ্ঞানের স্যান্ডার্ড মডেল বলে মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাং সংঘটিত হওয়ার পর যত গুলো মূল কণিকা সৃষ্টি  হয়েছে তখন সমানসংখ্যক প্রতিকণা ও সৃষ্টি  হয়েছে।

তাহলে প্রতিকণারা গেল কোথায়? 

বাংলাদেশের একজন গবেষক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার আরো "একটুখানি বিজ্ঞান " বইয়ে লিখেছেন, "মহাবিস্ফোরণের পর সমান সংখ্যক কণা ও প্রতিকণা সৃষ্টি হয়েছে। সেসব কণা ও প্রতিকণারা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যায় আর পড়ে থাকে শুধু শক্তি। কণা ও প্রতিকণারা ধ্বংস হয়ে গেলেও কোন এক কারণে কিছু সাধারণ কণা বেচে যায়। সেই বেচে যাওয়া কণা গুলো দিয়েই আমাদের মহাবিশ্ব তৈরী।"

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কিছু কণা বেচে যাওয়ার সুযোগ কি আছে? উত্তর হলো নেই। কারণ প্রতিটা কণার সাথে একটা করে প্রতিকণা তৈরী হবে এবং সংঘর্ষ হলে সবগুলো কণা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই কিছু কণা বেচে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান একটা সমাধান দিয়েছেন। ফাইনম্যান মনে করেন প্রতিকণারা সময়ের উল্টো দিকে গতিশীল। আমাদের মহাবিশ্বের সময় সবসময়ই সামনের দিকে চলে। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের পর সময় দুই দিকে চলা সম্ভব নয়। আমাদের মহাবিশ্বের সময়ের প্রবাহকে যদি ধনাত্মক ধরি, তাহলে বিগব্যাং এর পর বিপরীত দিকেও যদি সময়ের প্রবাহ ঘটে, সেটাকে ঋণাত্মক সময়ের প্রবাহ ধরতে পারি। যদি মহাবিস্ফোরণের থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিকণা গুলো ছুটে যায় ঋণাত্মক সময়ের দিকে, তাহলে কণা আর প্রতিকণার সংঘর্ষ ঘটার সু্যোগ থাকে না।    

বিজ্ঞানী মিশিও কাকু তার "ফিজিক্স অব দ্যা ইম্পসিবল" বইয়ে লিখেছেন,"প্রতিকণারা সবসময়ই সময়ের উল্টো দিকে প্রবাহিত হয়ে একটা প্যারালাল ইউনিভার্স গঠন করেছে। সেই মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ রুপে প্রতিকণা দিয়ে তৈরী।" মিশিও কাকুর কথায়ও যুক্তি আছে।  

এখন আরেকটি প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা গবেষণাগারে যে প্রতিকণা গুলো তৈরি করছি সেগুলো কোথা থেকে আসে। এগুলো কি সেই প্যারালাল ইউনিভার্স থেকেই আসে? এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান এখনো দিতে পারেনি। প্রতিকণার বিষয়ে প্রচলিত কোন তত্ত্বই এখনো প্রমাণিত হয়নি। কতদিনে এই সমস্যার সমাধান হবে তাও অজানা। 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ